ভাইরাস সন্ত্রাস
সহাস্রাধিক মৃত্যু, অর্ধশত হাজার আক্রান্ত
করোনা সন্ত্রাসবাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর : হো প্রধান
বৃটেনে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা
এক ব্যক্তির মাধ্যমে ১১ জনে বিস্তার সন্দেহে ব্রাইটনে জিপি ও স্কুল বন্ধ
করোনাভাইরাসের নাম দেয়া হয়েছে ‘কোভিড-১৯’
সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত দুই বাংলাদেশী
লণ্ডনের চায়না টাউনে মানুষের আনাগোনা কম
সুরমা ডেস্ক
লণ্ডন, ১৩ ফেব্রুয়ারী – বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়াচ্ছে ভয়াবহ সংক্রামক ব্যধি করোনাভাইরাস। ভয়ঙ্কর এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ইতোমধ্যে প্রায় সহাস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং অর্ধশত হাজারের মতো লোক আক্রান্ত হয়েছেন। বুধবার পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে এ পর্যন্ত ১,১১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তম্মধ্যে শুধু চায়নাতেই মৃত্যু হয়েছে ১,১১৪ জনের। বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৩,১৩২ জন। তম্মধ্যে চীনে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ৪২,৬৭৭। ভাইরাস থেকে আত্মরক্ষার্থে মানুষের পাশাপাশি গৃহপালিত পশুদের মাস্ক পড়তে হচ্ছে। তবু নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হো’র ডাইরেক্টর জেনারেল ভাইরাসটিকে সন্ত্রাসবাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে মন্তব্য করেছেন।
চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হওয়া ভাইরাসটি এখনো অনেকটাই অজানা বিজ্ঞানীদের কাছে। রোগের ধরন দেখে এটাকে করোনাভাইরাস-গোত্রীয় বলে নিশ্চিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। ২০১৯ সালের শেষ দিকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটিকে দেড় মাস ধরে চীনের নতুন করোনাভাইরাস হিসেবেই ডাকা হচ্ছে। তবে এই নতুন করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট রোগের একটি নাম অবশেষে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যারা নামকরণ করা হয়েছে ‘কোভিড-১৯’। ১১ ফেব্রুারী, মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হো এই নামকরণ করে।
এদিকে, ব্রাইটনে সিঙ্গাপুর ফেরত এক ব্যক্তির মাধ্যমে ১১ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়ানোর বিষয়ে সন্দেহ করা হয়। যার কারণে ইস্ট এণ্ড ওয়েস্ট সাসেক্সের কয়েকটি স্কুল জিপি ও হেলথ সেন্টার বন্ধ ঘোষণার পর আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। ভাইরাস আক্রান্ত হিসেবে চিকিৎসা প্রাপ্তদের মধ্যে দুই ডাক্তারও রয়েছেন। তবে সিঙ্গাপুর থেকে ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে আসা ওই ব্যক্তি এখন ভাইরাসমুক্ত ও মানুষের জন্য ঝুঁকি নয় বলে এনএইচএস ইংল্যাণ্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার হাসপাতাল থেকে তাকে ছাড়পত্র দিয়ে পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া এই ভাইরাস আশপাশের এশিয়ার দেশগুলোতেই ছড়াচ্ছে বেশী। চীনের বাইরে হংকং ও ফিলিপাইনে মৃত্যু হয়েছে একজন করে। পাশ্ববর্তী জাপান ও সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের সংখ্যা বেশী। এশিয়ার বাইরে ইউরোপ, আমেরিকায়ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস। বৃটেনে এযাবত ৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ফ্রান্সে ১১ জন এবং আমেরিকায় ১৩ জনের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমণ সনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভিতরে এখনো কারো মধ্যে তা সংক্রমণ না ঘটলেও সিঙ্গাডপুরে দুই বাংলাদেশী আক্রান্ত হয়েছেন। ইণ্ডিয়ায় ইতোমধ্যে ৩ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে দেশটিতে সমালোচনা বাড়ছে। এরই মধ্যে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায়ে চীনের বেশ কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার চাকরি গেছে। সম্প্রতি বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইতোমধ্যে বেইজিংয়ের একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে তাঁর জনসমক্ষে আসা ও হাসপাতাল পরিদর্শনের ঘটনাকে বিরল হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। তবে তিনি এখন পর্যন্ত উৎপত্তিস্থল হুবেই যাননি।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আরও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন সি চিন পিং। চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তাঁদের সেই আত“বিশ্বাস থাকতে হবে যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিতবেন।
সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত দুই বাংলাদেশী:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুরে দুই বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁরা দুজনেই একই জায়গায় কাজ করতে যেতেন। সব মিলিয়ে এদিকে সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম বাংলাদেশির শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি বলে সেখানকার একাধিক কূটনীতিক সূত্র এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছে। মঙ্গলবার রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অসুস্থ ওই বাংলাদেশিকে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ বা এনসিআইডির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম বাংলাদেশির মতো দ্বিতীয়জনেরও চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ করোনা ভাইরাসের উপসর্গ পাওয়ার পর তিনি পরদিন অর্থাৎ ৭ ফেব্রুয়ারী একটি সাধারণ ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে যান। ১০ ফেব্রুয়ারী তিনি এনসিআইডিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে যান। সেখানে তাঁর করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এ মুহূর্তে তিনি সিঙ্গাপুরের বিশেষায়িত হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইনে আছেন।
সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দ্বিতীয় বাংলাদেশি সেখানকার বীরাস্বামী এলাকায় থাকেন এবং সেলেটার অ্যারোপেস হাইটসে কাজ করতেন। ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথমজনও কাজ করতেন সেলেটার অ্যারোপেস হাইটসে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগের কারণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কাকি বুকিত এলাকার ১৯ জনকে কোয়ারেন্টাইন করে। তাঁদের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশের নাগরিক। গত ২১ জানুয়ারী থেকে এ পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৮৮১ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে।
পালানোর আশঙ্কায় কোয়ারেন্টাইন জোরদার করেছে বৃটেন:
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। নতুন করে আরও চারজন এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। ভাইরাস যাতে ছড়াতে না পারে, সে জন্য দেশটির সরকার এ ভাইরাসে সংক্রমিত, এমন সন্দেহভাজন লোকজনকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন করে রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
বিবিসির রাজনৈতিক প্রতিবেদক ইয়ান ওয়াটসন বলেন, চীনের উহান থেকে যুক্তরাজ্যে আসা প্রথম ফ্লাইটের একজন যাত্রী উইরালে বর্তমানে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। তিনি গা ঢাকা দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নতুন এ পদক্ষেপ ঘোষণা করে। বর্তমানে যে নিয়ম, তা তাঁকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন করে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই নতুন এ নিয়ম জারি করা হয়েছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, দেশটির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনাভাইরাসকে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ও আসন্ন হুমকি বলে উল্লেখ করেছে। তবে যুক্তরাজ্যে এ ভাইরাসের কারণে ঝুঁকির পর্যায়টি সহনীয় বলে জানিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশী, যার অধিকাংশই চীনে। চীনে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের কারণে ৯০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকারের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা অধ্যাপক ক্রেস হোইটি বলেন, নতুন করে আক্রান্ত চারজন আগের চার রোগীর সংপর্শে এসেছিল। তারা ফ্রান্সে থাকার সময় এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। তাদের লন্ডনে গাইজ অ্যান্ড সেন্ট থমাসের এনএইচএস সেন্টারে এবং রয়েল ফ্রি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে।
পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উহান থেকে যুক্তরাজ্যে আসা দ্বিতীয় ও শেষ ফ্লাইটে প্রায় ২০০ ব্রিটিশ নাগরিক দেশে ফিরেছে। তাদের মি?ন কিনস কনফারেন্স সেন্টারে ১৪ দিনের কোয়ারেনটাইন করে রাখা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যুক্তরাজ্যের এক নাগরিককে গত বৃহপতিবার ব্রাইটন থেকে লন্ডনে সেন্ট থমাস হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তিনি দেশটির তৃতীয় ব্যক্তি, যাঁর মধ্যে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
ফ্রান্সের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ফ্রান্সে পাঁচ ব্রিটিশ নাগরিক করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়। তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এক ব্যক্তির সংপর্শে আসার পর আক্রান্ত হয়।
লণ্ডনের চায়না টাউনে মানুষে আনাগোনা কম:
করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে লণ্ডন সিটির প্রাণকেন্দ্র সোহো এলাকার চায়না টাউনেও। রাতদিন মানুষের উপচে পড়া ভিড় যেখানে লেগেই থাকে সেই জমজমাট চায়না টাউনেও মানুষের আনাগোনা তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। চীনা খাবারের জন্য বিখ্যাত লণ্ডনের চায়না টাউন। চীনের বাসিন্দাদের হাতে তৈরি খাবার মেলে এখানে। সারাক্ষণ জমজমাট এই এলাকায় এখন করোনাভাইরাস আতঙ্ক। চীনের করোনাভাইরাস আতঙ্ক সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে ধরা পড়েছে চায়না টাউনের ভিন্ন চিত্র। সারাক্ষণ জমজমাট এই এলাকা যেন অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। খাবারের দোকানে লোকের সমাগম নেই। সেখানকার রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও যাচ্ছে মাস্ক পরে। খাবারের দোকানের সামনে ভিড়ভাট্টা তেমন নেই। কিছু কিছু দোকানে একেবারেই সুনসান নীরবতা। খাবারের দাম কমিয়ে দিয়ে বিশেষ অফার দিয়েও নাকি কাঙিক্ষত ক্রেতা পাচ্ছেন না অত্র এলাকার রেস্তুরা ব্যবসায়ীরা।
দিনে যেখানে কয়েক হাজার পাউণ্ডের খাবার বিক্রি হয়, সেখানে তা শতকে এসে থেমেছে। কোনো কোনো দোকানে একেবারেই বিক্রি বন্ধ হওয়ার জোগাড়। সাধারণত অনেকে বাড়ি থেকে অর্ডার করেও খাবার কেনেন, কিন্তু সেই অর্ডারও নাকি নেই বললেই চলে। ডেলিভারি ম্যানদের অনেকে বসে আছে। কোনো কোনো দোকান বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক দোকান বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া করা হয়। ক্রেতারা তাও বাতিল করে দিচ্ছেন।