মুক্তচিন্তা

বৃটেনের সাথে ডিপার্টেশন চুক্তি: ১২ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর ভবিষ্যত কী?

।। হাসান আল জাভেদ ।।

বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা গণতন্ত্রহীনতার কারণে বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশীদের মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে ডিপোর্টেশন/রিমুভাল বা জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো আতঙ্ক। প্রচার হচ্ছে গত একবছরে আশ্রয় প্রার্থীদের মধ্যে রিফিউজ হওয়া ৯৫ শতাংশ বা ১০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত যেতে হবে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশে ‘ফার্স্ট ট্র্যাক এগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী আসলে কী হচ্ছে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে, কী আছে এসাইলাম আইনে?

এ নিয়ে যুক্তরাজ্যর ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্ট, ইমিগ্রেশন সলিসিটর বা আইনজীবী, কমিউনিটি ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তারা বলছেন, একজন ব্যক্তি ধর্মীয়, জাতি-বর্ণ, রাজনৈতিক মতামত বা লৈঙ্গিক পরিচয় প্রভৃতি কারণে নিজ দেশে হুমকির মুখোমুখি এবং যুদ্ধাবস্থায় বাস্তুচ্যুতি হলে রাজনৈতিক আশ্রয়ের যোগ্য। যুদ্ধাবস্থা ছাড়া বাংলাদেশেও সবকটি উগসর্গগুলো বিদ্যমান।

যুক্তরাজ্যও ১৯৪৮ সালের ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস স্টেটস এবং ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন আইনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ করছে। সে হিসেবে একজন আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন প্রাথমিকপর্যায়ে বাতিল হলেও আপিলের পরবর্তী ধাপগুলো রয়েছে। এতে ৯৫ শতাংশের ফেরত পাঠানোর সুযোগ নেই।

অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাজ্যর ইমিগ্রেশন বর্ডার বা দেশটির অভ্যন্তরে এসে যে কারও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থণার অধিকার আছে। আশ্রয় আবেদনের সময় ইমিগ্রেশন পুলিশ একটি সাক্ষাতকার নিয়ে থাকে যাকে ‘স্ক্রিনিং ইন্টারভিউ’ বলা হয়।

এপর্যায়ে খুব অল্প সংখ্য আবেদন গ্রহণ করা হয়। স্ক্রিনিং ইন্টারভিউ পরবর্তী হোম অফিসেই (যুক্তরাজ্য পুলিশ) চূড়ান্ত সাক্ষাতকার নেয়া হয়ে থাকে। গত এক বছরে বাংলাদেশিদের ৯৫ শতাংশ আবেদন যেখানে রিফিউজড বা বাতিল হয়েছে।

১০ হাজার আশ্রয়প্রার্থী এখনই ফেরত অসম্ভব কেন

যুক্তরাজ্য বা বিশ্বব্যাপী এসাইলাম প্রক্রিয়ায় সাক্ষাতকারে কোন ব্যক্তির আবেদন বাতিল হলেও তিনি আপিলের সুযোগ পান। আদালতে আপিলে রিফিউজ বা বাতিল হলে পুণরায় ট্রাইব্যুনালে আপিল এবং সর্বশেষ নতুন আবেদন করা যায় যুক্তরাজ্য। আর ব্রিটেনে এসব প্রক্রিয়াগুলো শেষ করতে সাধারনত ৩ থেকে ১০ বছরও লেগে যায়। সেটা একজন কেস অফিসারের কাজের চাপের ওপর নির্ভর করে।

লন্ডনিয়াম সলিসিটরস ফার্মের ব্যারিস্টার এম লিয়াকত আলী বলেন, যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন আইনে একজন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন চূড়ান্ত সাক্ষাতকারে বাতিল হলে তাকে ফার্স্ট টিয়ার ট্র্যাইবুনালে আপিলের সুযোগ দেয়া হয়। সেখানে প্রথমবার রিফিউজ হলে দ্বিতীয়বার যাওয়া যায়। সেখানেও বাতিল হলে আবেদনকারীর জীবনের নিরাপত্তা সম্বলিত অবস্থার পরিবর্তন আসলে লিভারপুল কোর্টে ফ্রেশ সাবমিশন করতে পারে। ওই কোর্টে বাতিল হলেই ফেইলড এসাইলাম সিকার বলা হয় এবং ফেরত পাঠানোর প্রসঙ্গ আসে। এর আগে একজন আশ্রয়প্রার্থীকে পাঠানোর সুযোগ নাই।

তিনি বলেন, গত এক বছরের যারা এসাইলাম আবেদন করেছেন তাদের বেশিরভাগই এসেছেন স্টুডেন্ট, কেয়ার ভিসায় এবং ভিজিট ভিসায়। তাদের বেশিরভাগেরর সাক্ষাতকারে আবেদন বাতিল হলেও ট্র্যাইবুনালে মামলা চলমান। সুতরাং এই ১০ হাজারেও বেশি পাঠানোর বিষয়টি অবান্তর।

এম লিয়াকত আলী বলেন, চূড়ান্ত সাক্ষাতকারে গত একবছরে ৫ শতাংশের আবেদন গ্রহণ করা হলেও একইসময়ে আপিলে আরও ৩০ শতাংশের আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। সে হিসেবে যুক্তরাজ্যে গত এক বছরের মঞ্জুরের হার ৩৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের সঙ্গে ‘ফার্স্ট ট্র্যাক এগ্রিমেন্ট’ কী: ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফার্স্ট ট্র্যাক এগ্রিমেন্ট সাধারণত এসাইলাম আইনের আওতাভুক্ত নয়। এটা দেশের সঙ্গে দেশের চুক্তি। সাধারণত একজন আবেদনকারী যখন ট্রাইব্যুনাল শেষে পুণরায় আবেদন সবখানেই রিফিউজ হন তিনি ‘ফেইলড এসাইলাম সিকার’ হিসেবে যুক্তরাজ্যে বসবাসের অধিকার হারিয়ে ফেলেন। এরপরও তিনি নিজ দেশে ফেরত না গেয়ে বসবাস করতে গেলে আনডকুমেন্টেড বা অবৈধ হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে তাকে ডিপোর্ট বা জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হয়।

ফেরত পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে তার নাম, পরিচয়, ঠিকানা পাঠিয়ে ইমিগ্রেশন পাস চাওয়া হয়। পাসপোর্টের বিকল্প হিসেবে ‘ওয়ানওয়ে ট্রাভেল পাস’ নিয়ে যুক্তরাজ্যের এয়ারপোর্ট অতিক্রম করে বাংলাদেশ ফেরত পাঠানো হয়ে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, এমআরপি এবং ই-পাসপোর্ট চালুর আগে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একজন আনডকুমেন্টেড প্রবাসীর ইমিগ্রেশন পাস প্রদান করা কঠিনতর হতো। কারণ যারা সাগরপথে এসেছেন তারা যুক্তরাজ্য পাসপোর্ট জমা দেননি। আবার যাদের পাসপোর্ট ছিল সেগুলো বাংলাদেশে ভেরিফিকেশন করলে নাম-ঠিকানায় অসামঞ্জস্য থাকতো। বাংলাদেশি দূতাবাস তাদের ইমিগ্রেশন পাস প্রদান না করলে ডিপোর্টও সম্ভব ছিলনা। নতুন চুক্তিতে বাংলাদেশ দূতাবাস হয়তো এমআরপি এবং ই-পাসপোর্টধারীদের স্থায়ী ঠিকানায় যাচাই-বাছাই না করেই দ্রুততম সময়ে ইমিগ্রেশন পাস প্রদান করবে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য হোম অফিসও বাংলাদেশিদের আবেদন প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত সম্পন্ন করবে।

যুক্তরাজ্যের সলিসিটর মাহবুবুর রহমান বলেন, এই চুক্তি মূলত তাদেরই রিমুভাল করা হবে যারা ফেইলড এসাইলাম সিকার, যারা ওভারস্টেয়ার (ভিসার মেয়াদ শেষেও বসবাস) এবং অফেন্ডার বা এই দেশে অপরাধ করে এক বছরেরও বেশি সময়ের জন্য জেল-জরিমানার মুখোমুখি হয়েছে তাদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের রিমুভাল করার কথা। গত বছর আলবেনিয়ার সঙ্গে ব্রিটেন একই ধরণের চুক্তি করে ২৬ হাজার রিমুভ করে।

তিনি বলেন, বিট্রিশ সরকারের প্রতিনিধিদল ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে আনডকুমেন্টেডদের ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই অঙ্গীকার অনুযায়ী গত ১৬ মে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কুইক রিমুভাল বা স্ট্রিমলাইনের কারণে প্রকৃত এসাইলাম সিকার যাদের মামলা পেন্ডিং রয়েছে তাদের সমস্যা না হলেও অনেক প্রকৃত আবেদনকারী ভুক্তভোগী হবেন এমনটা মনে করেন এই আইনজীবী। তার মতে, বাংলাদেশে বিরোধীদের দলের অনেক নেতাকর্মী আছেন যারা প্রকৃতভাবে ভুক্তভোগী কিন্তু ব্রিটেনের লিগ্যাল সিস্টেমে তা প্রমাণ করতে পারছেনা। যে কারণে এ ধরণের চুক্তি মানবাধিকারের বিপক্ষে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাজ্য বিশেষ করে লন্ডনে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন সভা-সেমিনার কিংবা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছে। ‘ফার্স্টট্র্যাক এগ্রিমেন্ট’ বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন অভিযোগ এনে সর্বশেষ গত ৩ জুন আলতাব আলী পার্কে বিক্ষোভ করেন ‘নিরাপদ বাংলাদেশ চাই ইউকে’ সংগঠনটি। ‘ইক্যুয়াল রাইটস ইন্টারন্যাশনাল (ইআরআই), নিরাপদ বাংলাদেশ চাই সহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে ডিপোর্টেশন বন্ধে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে স্বারকলিপিও পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।

নিরাপদ বাংলাদেশ চাই ইউকে’র সভাপতি মুসলিম খান বলেন, যে দেশে একজন সরকার দলীয় এমপির টুকরো টুকরো লাশ করা যায় সেই দেশে সাধারন মানুষের নিরাপত্তা স্পষ্ট। তাই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রদানের ক্ষেত্রে ব্রিটেনে যতগুলো কারণ যৌক্তিক দীর্ঘদিন গণতন্ত্রহীনতায় বাংলাদেশে ঠিক ততগুলোই বিদ্যমান। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাকেই গুম-খুন করা হচ্ছে। এই অনিরাপদ দেশটি হতে কাউকেই আপিলের পর্যায়গুলো শেষ না করে ফেরত পাঠানো সম্ভব না। মানবাধিকার মুসলিম খান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের অতিউৎসাহী এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত এই চুক্তি আবেদনকারীদের ওপর নতুন করে তেমনটা প্রভাব ফেলবে না।

যুক্তরাজ্যের একখন্ড বাংলাদেশ নামে পরিচিত পূর্বলন্ডনের রাজধানী বলা হয় হোয়াইটচ্যাপেল বা ব্রিকলেনকে। গত ১৬ মে’র পর সেখানে মূখ্য আলোচনায় এসাইলাম সিকারদের রিমুভাল বা ডিপোর্টেশন। এ নিয়ে উদ্বেগ-উতকণ্ঠা রয়েছে আশ্রয়প্রার্থী ও তাদের স্বজন এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী শিবিরে। ব্রিট্রেনের জাতীয় নির্বাচনের পর এই চুক্তি থাকবে নাকি পরিবর্তন আসবে এ নিয়ে মতদ্বৈততা রয়েছে। তবে তারা বিশ্বাস করেন লেবার পার্টি বা অন্য কোন দল ক্ষমতায় এলে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার চেষ্টা করে। তখন হয়তো এই চুক্তির ব্যত্যয় ঘটতে পারে।

পূর্ব লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ বলেন, বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ বিনা বিচারে জেল-জুলুমের শিকার। এজন্য সামান্য রাজনীতি করলেই শতশত মামলা হচ্ছে। তাদেরকে তাড়াহুড়া করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আইনের ফের লঙ্ঘন। তারা যাই অপচেষ্টা করুন যুক্তরাজ্য মানবাধিকারের দেশ। এখান থেকে ফেরত গিয়ে কেউ সরকারের ফাঁদে পড়বে না এটা বিট্রিশরা চাইবে না।

ব্রিটেন সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ড. হাসনাত হোসাইন এমবিই বলেছেন, এই চুক্তিটা পুরোপুরি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনীতিবিদ বা এ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে যারা প্রাণ বাঁচাতে এই দেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের দমনের পুণরায় পাঁয়তারা। ব্রিটেন সরকার এবং তাদের গণমাধ্যমের রিপোর্টে বাংলাদেশের গুম-খুন-নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে। তারা মানুষকে ফের বিপদে ফেলে দিতে পারেনা। আশাকরি এই সমস্যারও সমাধান হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close