নিউজ

কম্পিউটার বনাম বন্দুক 

।। শামসুল আলম লিটন।।

একাত্তরের সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা বিজয়ী হয়েছি। এবারও বিজয়ী হবো। তখন ছিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক আন্দোলন। আর এটা শিক্ষা আন্দোলন। যেটা ইতিমধ্যে সর্বাত্মক রূপ নিয়েছে গণ আন্দোলনে। 

এখন এই আন্দোলন ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিরূপণ করবে। এটা আর কোন সাধারণ আন্দোলন রইলো না, যখন রাজপথে প্রচুর রক্ত ঝরলো। এটা সর্বাত্মক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। এই যুদ্ধে বিজয়ী না হয়ে তারা ঘরে ফিরবে বলে মনে হয় না। কারণ ইতিমধ্যে অভিভাবক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ এক কাতারে এসেছে। ছাত্রদের এত রক্ত বাংলাদেশের রাজপথে আর কখনো ঝরেনি। এমনকি ভাষা আন্দোলন ও ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে ও ঢাকায় ছাত্রদের এমন রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি। এটা রাস্তার লড়াই নয়, ঘরে বসে তাদের মধ্যে অনেকেই এই প্রথম সরকার বিরোধী এবং সরকারের নীতি বিরোধী কাজ করছে। ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে। এটা নতুন ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচি। এখন কম্পিউটারের যুগ। কম্পিউটার প্রযুক্তি এই যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগের মত রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ তাদের মারতে পারবে না। তাদের অগ্রজ বাহিনী বুক চিতিয়ে পুলিশকে মোকাবেলা করতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন, আর তার চেয়ে আরো কয়েকগুণ প্রস্তুত হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতিদিন অন্যায়ের বদলা নিতে। তার চেয়ে আরো কত গুণ কি-বোর্ড হাতে বসে আছে তা গবেষণা করে বের করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। সুতরাং কম্পিউটারের শক্তি আর বুলেটের শক্তির এ লড়াইয়ে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, বুলেট ফুরিয়ে যাবে, বন্দুক চলবে না কিন্তু প্রযুক্তির শক্তি সীমাহীন। যেটি বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারে এবং এটা কতটা বহুমাতৃক, তা কয়েকটি বিষয় থেকেই আপনার লক্ষ্য করবেন।

প্রযুক্তিতে বলিয়ান এই তরুণরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট বারবার হ্যাক করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখে এই যুদ্ধে তাদের বীরত্ব ও অপ্রতিরোধ্য বলিষ্ঠতা প্রমাণ করেছে। এখানে সরকার ও রাষ্ট্র তাদের কাছে এতটাই অসহায় যে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবসায়ীদের ডেকে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছে। ধারণা করা যায়, তিনি ব্যবসায়ীদের সাপ্লাই চালু রাখার অনুরোধ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাক হওয়ার পর ব্যাংকগুলো অচল ও ইন্টারনেট না থাকাতে লেনদেন প্রায় বন্ধ। এলসি খোলা যাচ্ছে না। বিদেশীরা বাকীতে কাঁচামাল দেবে না।কারফিউ থাকার কারণে স্বাভাবিক লেনদেন বলে কিছু নেই। ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে কাঁচামাল আনা যাচ্ছে না। তাহলে তারা উৎপাদন আর সাপ্লাই স্বাভাবিক রাখবেন কিভাবে? এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

শেখ হাসিনার এই অসহায়ত্ব অপ্রতিরোধ্য তারুণ্যের জন্য এক একটি বিজয়ের অধ্যায় রচনা করেছে। খুবই সীমিত মাত্র কয়েকশো গজ পর্যন্ত বুক চিতিয়ে থাকা ছাত্রদের বুক আর মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া যায়, তাদের হত্যা করা যায়। কিন্তু লক্ষ লক্ষ তরুণ দেশের ভেতরে, আরো কয়েক লক্ষ তরুণ দেশের বাইরে। তাদের মাথার মধ্যে এক একটা ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে বসে আছে। তাদের মোকাবেলা করবে কে? এই কারণেই এই বারের ছাত্র আন্দোলনে রাস্তায় যত মানুষকে দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে মেধা আর সংখ্যায় হয়তো এর চেয়ে কয়েক গুণ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসে তাদের ক্যান্টনমেন্ট গুলো থেকে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের স্পর্শ করার মতো বন্দুক এখনো পৃথিবীতে আসেনি। এটা এই যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্র।

সোজা কথা এই যুদ্ধে সরকারের হাতে যে শক্তি আছে সেটা সবাই জানে। কিন্তু যুদ্ধের টেকনিক, যুদ্ধের এলাকা, যুদ্ধের অস্ত্র আর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী- বিরোধীদের এই চারটি বিষয়ে সরকারের কোন ধারণা থাকার কথা নয়। সেই কারণেই পুরো ব্যবস্থাই যে বদলে গেছে এটা কেউ কেউ এখনো হয়তো বুঝতে পারছে না। এই আন্দোলন সকলের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে।

রাজনীতির ইতিহাসে বাংলাদেশের চ্যাপ্টারে এটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এ ব্যাপারে সেই কথাটি স্মরণ করা যায়। গোখলের ভাষায় “হোয়াট ইন্ডিয়া থিংকস টুডে, ওয়ার্ল্ড থিংকস টুমোরো।” এখন সেটা দাঁড়াবে “হোয়াট বাংলাদেশ থিংকস টুডে, ওয়ার্ল্ড থিংকস টুমোরো।”

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিটিভি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। যে পক্ষ থেকেই হোক, এখানে একটা বড় ইঙ্গিত আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ ব্যবস্থার মেরুদন্ড। আর বিটিভি তথ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে। দুটোরই অকার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলো। অর্থনীতি ও তথ্যের প্রচারের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে সরকার জোর করে রাষ্ট্র ধরে রাখার যে শক্তি সেই শক্তিকে মূলত পর্যুদস্ত করা হয়েছে।

 ছাত্রদের আংশিক বিজয় হয়ে গেছে। এবার জনতা ছাত্রদেরকে তার রক্তের বদলা হিসেবে পুরো বিজয় কবে এনে দেবে সেটা নির্ভর করছে পুরো জাতি আর রাজনৈতিক নেতাদের উপর। নিত্য নতুন কৌশল যদি সঙগ্রামে  সংযুক্ত করতে না পারে তাহলে তারা এই প্রজন্মের কাছে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। গণঅভ্যুত্থানের জয় অথবা বিজয়ের পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাসঙ্গিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র ও একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা ও পরবর্তী ধাপে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও তারুণ্যের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অত্যন্ত কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত সময়। রাজনীতিকদের জন্য এটা এসিড টেস্ট। এই এসিড টেস্ট সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের। মেধাবীরা কিন্তু সবকিছুই বুঝতে পারছেন। কিভাবে বিজয়ী হতে হবে সেটাও তারা বোঝেন এবং জানেন তাদের কি করতে হবে।  সুতরাং তাদের এই বোঝাকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পর্যবসিত করার এখনই সময়।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক সুরমা।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close