সম্পাদকীয়

পিরোজপুরের নাটক এবং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা

বাংলাদেশের আদালতের উপর দেশের বিপুল সংখ্যা-গরিষ্ঠ মানুষের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। কারণ মানুষ জানে, অর্থ ও ক্ষমতার বলে সেখানে রায় খরিদ করা যায় এবং রায় বদলে দেয়া যায়। সরকারী দলের অপরাধীরা খুঁটির জোরে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সম্প্রতি একটি রায়কে কেন্দ্র করে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক বিচার বিভাগের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিচার বিভাগের উপর মানুষের বিদ্যমান অনাস্থাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুদকের মামলায় ক্ষমতাসীন দলের জেলা সভাপতি আব্দুল আউয়াল এবং তাঁর স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীনের জামিন নামঞ্জুর করাকে কেন্দ্র করে পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ মো: আব্দুল মান্নানকে তৎক্ষণাৎ বদলি করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সাথে সাথে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনকে ভারপ্রাপ্ত জেলা জজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারপর তড়িঘড়ি করে ভারপ্রাপ্ত জজের মাধ্যমে তাদের জামিন প্রদান করা হয়েছে। এ ঘটনা বিচার ব্যবস্থার ভয়াবহ অবনতির সাক্ষ্য বহন করছে।
ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী আসামী আব্দুল আউয়ালকে কারাগারে পাঠানোর আদেশের পরপর আওয়ামী লীগের কর্মী ও আব্দুল আউয়ালের সমর্থকরা এর প্রতিবাদে পিরোজপুর-পাড়ের হাট সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ করে রাখে। শহরের সার্কিট হাউস এলাকায় অগুন জ্বালায়। শহরের গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব সড়কে তারা প্রতিবাদ মিছিলও করে। যারা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে তারা অভিযুক্ত আব্দুল আউয়াল’র সমর্থকগোষ্ঠী, আরো স্পষ্টভাবে বললে তারা সবাই সরকারী দলের লোক। যারা ক্ষমতা ও গু-াবাহিনীর জোরে আইন হাতে তুলে নিতে চায় এবং বিচারকের বিরুদ্ধে হুমকি দেয় তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে নিরীহ বিচারককে বদলী করা যে কোনো বিচারে একটি ভয়াবহ অনৈতিক ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বাক্যবাগীশ আইন মন্ত্রীর মন্তব্য খুবই হাস্যকর। তিনি বলেছেন, বিচারক প্রত্যাহারে আইনের শাসনের ব্যত্যয় হয়নি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই এ ব্যবস্থা। এর মানে কি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় দলীয় ক্যাডারদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে? দলীয় ক্যাডাররা কি দেশের বিচার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক?

দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতি থাকলেও বিপদগ্রস্থ এবং ভূক্তভোগী মানুষের আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে দীর্ঘদিন থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের নির্বাহী বিভাগ প্রকাশ্য ও অবাঞ্চিতভাবে বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করে আসছে। গোপনীয়ভাবে সরকার বিচার বিভাগের সাথে কি করছে তা সহজেই অনুমেয়। সরকার দলীয় নেতাকে জামিন না দেয়ায় বিচারককে সাথে সাথে বদলি এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভারপ্রাপ্ত জজ কর্তৃক জামিন দেয়ার ঘটনা আইন ও বিচারের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। সরকার ও সরকারী দল আদালতের রায় নিয়ন্ত্রণের এ রকম ঘৃণ্য সংস্কৃতি চালু থাকলে দেশে ন্যায় বিচার ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙখা কখনো পূর্ণ হবে না।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

Back to top button
Close
Close