এতিমের হক: হাজার কোটি টাকার চামড়া ডাকাতি ও হাজার বছরের জেল
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে কুরবানী ঈদের পর চামড়া কেলেংকারী অন্যতম। এই কেলেঙ্কারির হোতারা হাজার কোটি টাকার চামড়া নামমাত্র মূল্যে গিলে খেতে গিয়ে পুরো চামড়া বাজার ধ্বংস করে দিয়েছে । এ কারণে এবছর কয়েক হাজার এতিমখানার লক্ষাধিক এতিমের হক ও সারা বছরের খাবার ও পড়াশোনার ব্যয় যে চামড়া থেকে আসতো সেটি চলে গেছে চামড়া সিন্ডিকেটের পেটে।
সরকার নিয়ন্ত্রিত চামড়া সিন্ডিকেট হাজার টাকা দামের গরুর চামড়াকে ৫০-৬০ টাকায় নামিয়ে আনে আর ছাগল কিংবা ভেড়ার চামড়াকে নামিয়ে আনে শূন্যে । যার ফলে হাজার কোটি টাকার এই চামড়া বাজার নেমে আসে বিনামূল্যে খরকুটোর বাজারে । এরমধ্যে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুবিধা করে দিয়ে সরকার নির্লজ্জভাবে চামড়া বাজারকে তুলে দিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ যারা চামড়াকে নিয়ে নতুন বৃহৎ শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে তাদের হাতে। যার ফলে একদিকে কুরবানীর চামড়া থেকে হাজার হাজার এতিমখানার সারা বছরের ব্যয় নির্বাহের সুযোগ এবারে শেষ হয়ে গেছে। অন্যদিকে দেশের চামড়া শিল্প পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাবে ধ্বংসের পথে যাবে । আর পর্যাপ্ত কাঁচামাল খুবই সামান্য মূল্যে কিনে সিন্ডিকেট কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নিয়ে পাচার করে দিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশে।
এই পুরো ঘটনাটা ঘটেছে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এবং তত্ত্বাবধানে। কুরবানীর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হলেও সরকার এবং তার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কোন ব্যবস্থা নেয়নি । এতেই চামড়া কেলেঙ্কারি এবং এর পুরো পরিস্থিতির দায় সরকারের ঘাড়ে পড়েছে । এ ব্যাপারে সরকার দায়মুক্ত এমন কোন দাবি তারা করেনি । পাশাপাশি সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করা অথবা এই ব্যাপারে জড়িত সরকারি-বেসরকারি চক্রগুলোকে চিহ্নিত করে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার কোন তদন্ত অথবা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যার ফলে এই কেলেঙ্কারির ফলে জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ এবং লক্ষ লক্ষ এতিম শিশুদের এবং এতিমখানা গুলো আগামী দিনে সম্ভাব্য করুণ পরিণতি নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ গুলো কোন দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
এবার আসা যাক চামড়া কেলেঙ্কারি পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনায়। এতিমদের মাত্র দুই কোটি টাকার মামলার জের ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। যদিও মামলা চলাকালে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে ওই অর্থ ব্যাংকের কাছেই রয়েছে । বরং ওই অর্থ ইতিমধ্যে কয়েক গুণ হয়েছে অর্থাৎ পরিস্থিতি প্রমাণ করেছে, বেগম খালেদা জিয়া কথিত ওই অর্থ থেকে একটি কানাকড়িও গ্রহণ করেননি অথবা উপকৃত (বেনিফিসিয়ারি) হননি। তাহলে এতিমের দুই কোটি টাকার ভিত্তিহীন অভিযোগে যদি সত্তরোর্ধ্ব একজন অশীতিপর বৃদ্ধার ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে চামড়া কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অপরাধে দায়ী সিন্ডিকেট সদস্যদের কয়েক হাজার বছরের জেল হবে কিনা সেটা আজ জাতির সামনে অনেক বড় প্রশ্ন?
বাংলাদেশের সংবিধানে একই অপরাধে একই ধরনের বিচার প্রক্রিয়া এবং শাস্তির বিধানের কথা বলা আছে । যেটাকে আইনের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক সমতা এবং আইনের দৃষ্টিতে আইন সকলের জন্য সমান’ মূলনীতির আলোকে বাংলাদেশের সকল বিচারকার্য পরিচালিত হবার কথা । এখন কথা হচ্ছে , বেগম জিয়ার মামলা যেহেতু এতিমের অধিকার হরণের অপরাধ আমলে নিয়ে বানোয়াট অভিযোগে ব্যবহার করা হয়েছে, এখন যা দিবালোকের মত স্পষ্ট, কিন্তু চামড়া কেলেঙ্কারির প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী দেশের লাখ লাখ মানুষ। এটি বাংলাদেশের সংঘটিত এ পর্যন্ত অন্যতম সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়া দাবি রাখে। বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। সুতরাং চামড়া কেলেঙ্কারি অচিরেই আইনের আওতায় যাবে এবং এই সিন্ডিকেটের প্রধান নেতা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সচিব ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ প্রধান ও সহযোগীদের অপরাধের মাত্রা অনুসারে হাজার বছরের জেল ভাগ করে দিয়ে আইনের শাসন ও সমতার নীতি বাস্তবায়নের স্বপ্ন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক অবশ্যই দেখতে পারে। তবে সেই স্বপ্ন বর্তমান সরকারের আমলে যদি কার্যকর নাও হয়, কখনো না কখনো সেটি কার্যকর হওয়ার ব্যাপারেও তাদেরকে স্বপ্ন দেখা থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা।
সবশেষে বাংলাদেশের একজন এতিম খানা প্রধানের (সঙ্গত কারণেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এ সম্পর্কে অভিমত হচ্ছে, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী অশীতিপর বৃদ্ধাকে এতিমের কথা বলে ভিত্তিহীন অভিযোগে যদি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে চামড়া কেলেঙ্কারি ও ডাকাতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লোপাটের সিন্ডিকেট প্রধান হিসেবে বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের অন্তত পাঁচ হাজার বছরের কারাদণ্ড হতে পারে । আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশে কখনো আইনের শাসন অবশ্যই সংবিধানের আলোকে জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে এবং ভবিষ্যতে লক্ষ কোটি মানুষের জীবিকার সঙ্গে প্রতারণা বন্ধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা হিসেবে হাজার বছরের কারাদণ্ডের বিধান চালু হতে পারে। মানুষের জীবন হয়তো ৭০/৮০ অথবা ৯০ বছরের বেশি নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ সভ্য দেশগুলোতে কোন কোন অপরাধীকে একশ থেকে দেড়শ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হয়ে থাকে। সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ এতিম অথবা নিরীহ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা, তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মানুষ রুপি শাসকের আসনে বসা চরম মানবতাবিরোধী ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দেশ দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপনের জন্য এ ধরনের হাজার বছরের কারাদণ্ডের বিধান এখন সময়ের দাবি। এধরনের হাজার বছরের কারাদণ্ড প্রধান প্রধান সভ্য সমাজে একটা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে । এই প্রত্যাশা সভ্য সমাজের বাসিন্দা সকলেরই থাকতে পারে এবং এটি কার্যকর হওয়ার ব্যাপারেও আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ ও বাস্তবতা আছে বলে এই লেখক ও বিশ্লেষণ বিশ্বাস করে।